দৈনিক প্রত্যয় সাহিত্য ডেস্কঃ
সকাল ভর্তি পরিক্ষা দিতে ঢাকায় যাবে। এবার সে এইচ এস সি পরীক্ষায় পাশ করেছে। তিন বিষয়ে লেটারসহ স্টার মার্কস নিয়ে কৃতিত্বের সাথে সে পাশ করেছে। উজ্জ্বল করেছে বিদ্যালয় ও পরিবারের মুখ। তাড়াতাড়ি গোজগাজ করে বেরিয়ে পড়তে হবে তা না হলে দেরি হয়ে যাবে। বাস আসবে বিকালে ৫ টাই তাই সব গুছিয়ে রাখতে হবে এখনি। একটা ছোট বাক্সে তার সকল প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্র গচ্ছিত ছিল। বাক্স খুলে সব কাগজ-পত্র বের করে দেখছে কোনটা লাগবে আর কোনটা লাগবেনা। কাগজে কাগজে সমস্ত ঘর একাকার করে ফেললো। হঠাৎ তার চোখ একটি বইয়ের উপর গিয়ে থমকে গেল। বইটি প্রখ্যাত উপন্যাসিক জাহিরুল মিলনের লেখা “পৃথিবীর আলো”। বইটির মলাটে ধূলা লেগে কিছুটা মলিন দেখালেও কি যেন এক অজানা ভালোলাগা মিশে আছে তার উপর। সকাল কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। মোচড় দিয়ে উঠল বুকের বাম পাশ। আকষ্মিক দু’গন্ড বেয়ে কয়েক ফোঁটা মুক্তার দানার মত অশ্রু বইটির উপর পড়ল। ডুকরে কেঁদে উঠল অবুঝ মন। পাশেই সেই রক্ত আর অশ্রু মাখা টি-শার্ট। নিজেকে আর সামলাতে পারলোনা টি-শার্টটি নিয়ে রক্তে ভেজা স্থানটা বারবার দেখতে দেখতে চুমু খেতে আর কাঁদতে লাগল। এরপর নিজেকে সামলে নিয়ে বইটি স্বস্নেহে নিজের হাতে তুলে নিয়ে শার্টের এক কোনা দিয়ে আলতো করে মুছে একটা চুমু খেয়ে জড়িয়ে নিল বুকে। হৃদয় ভেঙ্গে যেতে লাগল চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছে। চোখ মুছে বইটি মেলে চোখের সামনে। ভেসে উঠল সেই পুরাতন স্মৃতি।
সালটা ছিল ২০০০। আগষ্টের মাঝামাঝি। সকাল এসএসসি পাশ করে সবে কলেজে ভর্তি হয়েছে। বাড়ি শহর থেকে অনেক দূরে তাই হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করতে হয়। কলেজের প্রথমদিনে চোখে পড়ে এক অপরুপ সুন্দরী। দেখতে পরমা সুন্দরী গল্পে যাকে বলে পরীর মত। সকাল এমনিতে একটু লাজুক প্রকৃতির সহজে কোন মেয়ের সাথে কথা বলেনা। কিন্তু মেয়েটিকে দেখার পর তার খুব ভাল লাগল। কথা বলতে ইচ্ছে করল কিন্তু সাহসে পারল না। কিছুদিনের মধ্যে তার কয়েকজন বন্ধু হয়ে গেল। একসাথে চলতে চলতে সবার খুব কাছের মানুষ হয়ে গেল সে।
একদিন ক্লাস করে বন্ধুদের সাথে নিয়ে ক্যাম্পাসে বসার জন্য সকলে একটা জায়গা খুঁজছিল। হঠাৎ একটা নারী কণ্ঠ শুনতে পেল সকাল।
“এই মুর্তজা কোথায় যাচ্ছিস? এখানে আয়”।
সকাল তাকিয়ে দেখে সেই মেয়েটি।
সে জিজ্ঞাসা করে –“কে রে ও? তুই ওকে চিনিস?”
মুর্তজা বলে- “ও! ওর সাথে তোর পরিচয় হয়নি? ও আমাদের বন্ধু মেঘ। আমরা একই বিদ্যালয়ে পড়েছি। খুবই ভালো মেয়ে”।
-আসছি।
কথা বলতে বলতে মুর্তজা উত্তর দিল। তারপর সকালকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যায় সেদিকে। সকাল যেতে চাচ্ছিলনা। মুর্তজা একরকম জোর করে তাকে সেখানে ধরে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে মুর্তজা তাকে তাদের আসরে বসিয়ে দিয়ে পাশে বসে পরিচয় করিয়ে দিল।
“আমাদের বন্ধু সকাল”।
“সকাল! খুব সুন্দর নামতো!”
মেয়েটি হাসতে হাসতে বলল। সকাল লজ্জায় তখনো মাথা তোলেনি। যেন সে মস্তবড় অপরাধ করেছে। মেয়েটি তাকে জিজ্ঞাসা করল-
“তুমি মাথা নিচু করে আছো কেন?”
সকাল কোন কথা বলেনা।
“আমি মেঘ, জাহিরা মেহজাবিন মেঘ”। বলে মেয়েটি সকালের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। সকাল কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা।
“এই সকাল কি করছিস ? লজ্জা পাচ্ছিস কেন? এরা সবাই আমার বন্ধু”।মুর্তজা কিছুটা বিস্মিত হয়ে বলল।
সকাল এবার তার কাঁপাকাঁপা হাতটি মেঘের দিকে বাড়িয়ে তার হাতের সাথে মিলায়ে বলল
“আমি সকাল, জাহিন শাহরিয়ার সকাল”।
এবার সকাল মেঘের দিকে ভাল করে তাকালো। সেদিন দূর থেকে দেখেছিল। ভাল করে দেখা হয়নি। আসলেই সে পরমা সুন্দরী। টানা টানা চোখ, গোলাপের পাপড়ির মত দু’ঠোট, ভ্রমর কালো একগুচ্ছ চুল নেমে গেছে নিতম্ব পর্যন্ত। সে এক অনন্যা সুন্দরী যাকে প্রথম দর্শনে যে কেউ ভালবেসে ফেলবে।
“আমাদের দেখে লজ্জা পাবার কিছু নেই আমরা তোমার বন্ধু”।
হঠাৎ সে মেঘের কথায় সম্বিৎ ফিরে পেল। শুধু মাথা নেড়ে সে সম্মতি জানালো। তাদের মধ্যে অনেক কথাবার্তা হল তারপর যে যার বাড়ির দিকে রওনা দিল।
দিনের পর দিন পার হয়ে যায়। সকাল ও মেঘের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ট হতে লাগলো। তারা বন্ধুর মত তুমি থেকে তুইতে পৌছাল। সকাল ও মেঘ যেন একদিন দুজন দুজনকে না দেখে থাকতেই পারেনা। তাই প্রতিদিন তাদের কলেজে আসতেই হবে। সকাল অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। সে এখন কথা না বলে থাকতেই পারেনা। সেই এখন সকলের চেয়ে বেশি কথা বলে। বন্ধুদের আসরটা সেই নানান গল্পে মজিয়ে রাখে। মনে মনে সে মেঘ কে অনেক ভালোবাসে। মেঘও যে সকাল কে ভালোবাসেনা তা নয়। তার ও মনের কোনে সকালের জন্য একটা অধিকারের স্থান দিয়ে রেখেছে।
সকাল ও মেঘ দুজন দুজনার অনেক কাছাকাছি এলেও কেউই তাদের মনের ভাল লাগার কথা প্রকাশ করতে পারেনি। আসলে সাহসই হয়নি ওদের। ওদের দুজনারই ভাবনা যদি দুজনার মধ্যে এই নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়। কেউ যদি এই সম্পর্ক মেনে না নেয় তাহলে বন্ধুত্ব নষ্ট হবে এই ভয়ে কেউই সামনে এগুতে চাইনা। বন্ধু-বান্ধব সকলে জানে যে দুজন দুজনকে ভালোবাসে। শুধু ওরা দুজন জানেনা যে তাদের বন্ধুরা সকলে ওদের মনের কথা জানে।
“আজ ক্লাস শেষে লাইব্রেরীতে দেখা করবি“। সকাল মেঘ কে কলেজে গিয়ে বলে।
কেন?
“কথা আছে”।
“এখন বল”।
“লাইব্রেরীতে আয় তারপর শুনিস”।
সকাল মাথা নেড়ে হ্যা-সূচক ইঙ্গিত করল।
তারপর একটা মুচকি হেসে মেঘ ক্লাসে চলে গেল। সকালও ক্লাসে চলে গেল।
ক্লাস শেষে সকাল ও মেঘ যথাসময়ে লাইব্রেরীতে এসে হাজির হল। তারপর একটা নিরিবিরি জায়গা দেখে সামনাসামনি বসে পড়ল।
“কি হয়েছে রে পাগলা? মেঘ জিজ্ঞাসা করল।
সকাল একটু আমতা আমতা করে-
“মেঘ কি করে যে কথাটা বলব বুঝতে পারছিনা। তুই আবার কি ভাববি এই চিন্তা করছি”।
“আর ভনিতা করতে হবেনা। তোর আবার লজ্জা!” বিদ্রুপের সুরে মেঘ বলল।
“না মানে। একটা কথা বলব রাখবি?”
“আর মানে মানে করতে হবেনা। যা বলার চট করে বলে ফেল। তুই একটা বলবি আর আমি রাখবোনা! তাই কি হয়?”
“সত্যি! আমার কথা রাখবি?”
“আরে ঠিক আছে, রাখবো। এবার কি বলবি না আমি চলে যাব?”
“আসলে সত্যি কথা বলতে কি, একটু থেমে যায় সকাল।
“আবারও? আমি গেলাম”।
বলে উঠতে যাবে এমন সময় সকাল তার হাত চেপে ধরে। মেঘ পিছন ফিরে তাকাতেই
“আমি তোকে খুব ভালবাসি”। বলে মুখ নিচু করে সকাল।
“কি! কি বললি তুই! আবার বল”। কিন্তু সকাল মাথা নিচু করে বোবার মত বসে থাকে। আর মেঘ মিটমিট করে হাঁসতে থাকে। তারপর সকালের সামনে এসে দাঁড়িয়ে তার চিবুক হাত দিয়ে তুলে ধরে বলে
“ওলে বাবালে খোকা লজ্জা পেয়েছে। এই আমার দিকে তাকা। তাকা বলছি”। সকাল এবার মেঘের দিকে তাকায়। কিন্তু কিছু বলেনা।
“আমিও তোকে ভালবাসি”।
একথা শোনার পর সকাল তার নিজের কান কেও বিশ্বাস করতে পারছিলনা। আবেগে মেঘ কে জড়িয়ে ধরে বলল
“সত্যি তুই আমাকে ভালবাসিস?
হ্যাঁ, সত্যি, সত্যি, সত্যি। আমি শুধু ভয়ে তোকে বলতে পারিনি”।
“ওরে ফাজিল নিজের কথা আমার কাছ থেকে আগে জেনে নিলি?”
“বেশ করেছি , ঠিক করেছি। তোর মনের কথা আগে জেনে নিয়েছি”।
“আমরা আগে থেকে জানি”। হঠাত এমন কথা শুনে দুজনে যেন ভুত দেখার মত ভয় পেয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখে তার বন্ধুরা মিটমিট করে হাঁসছে।
“এখানে বসে ভালবাসার রঙ্গলীলা হচ্ছে তাইনা? মুর্তজা বলে তেড়ে আসে। -আমরা সব শুনেছি।
এগুলো শুনে দুজনেই লজ্জায় লাল হয়ে গেল। যেন পালাতে পারলেই বাঁচে।
তারপর থেকে দুজনার পথ এক হয়ে গেল। কলেজ ক্যাম্পাসে কেউ আসুক বা না আসুক এই প্রেমিক যুগলকে অবশ্যই দেখা যাবে। কলেজের সবাই জানত সকাল আর মেঘ একে অপরকে কতটুকু ভালবাসে। তারা দুজন দুজনকে এমন ভালবাসত যে কেউ তাদের সম্পর্কে খারাপ বললেও তারা বিশ্বাস করত না। অনেকে চেষ্টা করেছে তাদের সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরাতে কিন্তু তারা তাদের কথায় কোন পাত্তায় দিত না। তাই এখন আর কেউ তাদেরকে ঝামেলা করেনা। বরং যদি পারে সাহায্য করে। তারা বুঝে গেছে এদের ভালবাসা এত মজবুত যে কেউ তা ভাঙতে পারবেনা।
ক্লাস শেষে বাড়ি যাবার সময় মেঘ সকালকে ডেকে বলল
“আগামীকাল একটু সকালে কলেজে আসিসতো।
“কেন?
“আয় তারপর বলবো। আর শোন আগামীকাল থেকে আর তুই নয় তুমি করে কথা বলবো দুজনে। মনে থাকবে?
“আচ্ছা ঠিক আছে। বলে হাঁসতে হাঁসতে দুজনা বাড়ির পথ ধরল।
মেঘের বাড়ি কলেজ থেকে বেশি দূরে নয়। মুর্তজা ও সকালদের মেস থেকে সামান্য একটু দূরে। পায়ে হেঁটে গেলে পাঁচ মিনিটের পথ। সকাল ও মুর্তজা একই মেসে থাকে। প্রথমে মুর্তজা থাকত পরে সকালের সাথে বন্ধু সম্পর্ক হবার পর তাকে কাছে এনে রেখেছে। দুজনে একে অন্যের জন্য অন্তপ্রাণ। মুর্তজার গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহের একটি ছোট্ট গ্রামে। সে সেখান থেকে এসে মেঘের সাথেই একই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে। তাই তারা খুবই ভাল বন্ধু সেই থেকে।
সকাল পরেরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে পড়তে বসলো কিন্তু পড়ায় মন বসাতে পারল না। শুধু বারবার কলেজে যাবার জন্য মনটা ব্যকুল হয়ে উঠতে লাগল। উঠে নাস্তা সেরে কলেজে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগল। মুর্তজা তখনো ঘুমাচ্ছিল তাই তাকে আর না ডেকে একা একা কলেজে যাবার উদেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। পায়ে হেঁটে সে কলেজে এসে পৌঁছাল। তখনো কেউ কলেজে আসেনি। তবে কলেজের প্রধান ফটক খোলা রয়েছে। কলেজের ভিতর ঢুকেই সকাল চমকে উঠল। এত সকালে মেঘ কলেজে চলে এসেছে! আজ আর রক্ষে নেই। চুপিচুপি কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সকালকে দেখে মেঘ অভিমানে অন্যদিকে ফিরে দাঁড়াল। সকাল মেঘের আরো কাছে গিয়ে তার হাত ধরে বলল-
‘দেরি হয়ে গেছে সোনা।‘
‘দেরি হয়ে গেছে সোনা।‘ মুখ ভেংচে মেঘ সকালের কথার পুনরাবৃত্তি করল।
‘আমি সেই কখন থেকে উনার জন্য অপেক্ষা করছি আর উনি এখন এলেন।”
“ আচ্ছা ম্যাডাম ঠিক আছে আর কখনো দেরি হবেনা। এই কান ধরছি, নাক ধরছি”।
মূহুর্তে মেঘ সকালের হাত ধরে করুন স্বরে বলল
“সকাল তুমি হয়ত জান না আমার ধ্যান-জ্ঞান সবই তুমি। তুমি একটু চোখের আড়াল হলেই আমার ভয় হয় যদি তোমাকে আমার জীবন থেকে হারিয়ে ফেলি। তুমি হারিয়ে গেলে আমি আর বাঁচব না। কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে নাতো, কথা দাও”।
“ আচ্ছা কথা দিলাম তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও হারাবোনা। তুমি আমার প্রাণ আমি কেন তোমাকে ছেড়ে যাব বল”। সকাল মেঘকে জড়িয়ে ধরে বলল “ আমি সারাটা জীবন আমার এই বুকের মধ্যে তোমাকে আগলে রাখব। কোথাও হারিয়ে যাব না। মেঘ সকালের বুকে মাথা রেখে বলল “ আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যাব না। আমি শুধু তোমার ,শুধুই তোমারি”। এই মনে আর কারও স্থান হবেনা। এই মনের একমাত্র দাবিদার তোমার, অধিকারও তোমার, আর কারও না।
সকাল মেঘের মুখটা দুহাতে আলতো করে ধরে বলল “ আমি জানি তুমি আমার আর অন্য কারো না, আমিও তেমনি তোমার অন্য কারো না। এবার বল তোমার কি কাজ আছে বলেছিলে?”
“ওহ! সে কথাতো ভুলেই গেছি”। ব্যাগে হাত দিয়ে একটা রেপিং করা কি যেন বের করল মনে হয় বই আর একটা শপিং ব্যাগ। তারপর সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল “ এটি আমার তোমাকে দেয়া “প্রথম উপহার”। তোমাকে দেবার মত অনেক কিছুই ছিল কিন্তু আজকের দিনটিকে স্বরনীয় করে রাখার জন্য আমার এই ছোট উপহার। আমার পছন্দের একটা বই আর তোমার পছন্দের সাদা রঙয়ের একটা টি-শার্ট। শুধু তোমার জন্য। সকাল হাত বাড়িয়ে সেটা নিল এবং মেঘের কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল “পাগলি একটা, এর জন্য এতকিছু!”।
এইচএসসি ১ম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার ফাইনাল) দিন এগিয়ে আসছে। পরীক্ষার আর বেশিদিন নেই। সকলেই পড়ার টেবিলে দিন-রাত বই নিয়ে অধ্যায়নে ব্যস্ত। সকালেরও তাই পড়ার খুব চাপ। কলেজের ক্লাস আর শিক্ষকদের কাছে টিঊশনের পর দিন ফুরিয়ে যায়। রাত নেমে আসে তার প্রকান্ড বাহু মেলে। তেমনি সকালের চোখেও নেমে আসে রাজ্যের ঘুম। ঘুমকে দূরে সরিয়ে বসতে হয় পড়ার টেবিলে। ভাল ফলাফলের জন্য শিক্ষার্থীদের কত কি যে করতে হয়। সকাল ভাবে আর এভাবেই পড়ে চলে প্রতিরাতে।
সকাল তার পড়ার টেবিলে কম্পিউটার সাজেশন খুঁজছে। কিন্তু তার টেবিলের কোথাও তার হদিস পেল না। অগত্য কি আর করা খুঁজতে খুজতেই মুর্তজাকে জিজ্ঞাসা করল “ এই মুর্তজা আমার কম্পিউটার সাজেশনটা কইরে, তুই নিয়েছিস?”
“ না, আমি নিইনি, তুই না সেদিন জাহিদকে দিলি। তোর মাথা গেছে। ডাক্তার দেখা।“
“ভুলতো মানুষেরই হয়, একটা কথা জিজ্ঞাসা করলাম শুনিয়ে দিল এত্ত কথা। বলে দুজনেই হাঁসিতে ফেটে পড়ল।
“ এই মুর্তজা শোন, আজ সন্ধ্যায় তাহলে জাহিদের মেসে গিয়ে সাজেশনটা নিয়ে আসব, কেমন?”
“আচ্ছা” বলে মুর্তজা সম্মতি জানালো।
সকাল আজ মেঘের দেয়া টি-শার্টটি পরেছে। উপহার দেয়ার পর একদিনও পরেনি আজই প্রথম পরল। এজন্য অবস্থা মুর্তজার টিপ্পুনি মার্কা হাসি সকালের চোখ এড়াইনি। মেঘদের বাসার দুই/ তিনটে বাসার আগে সকালের বন্ধু জাহিদের মেস। জাহিদের সাথে সেখানে সকালের বন্ধু রাজীব, কামাল এবং রাহাতও থাকে। সন্ধ্যায় মুর্তজাকে নিয়ে সকাল জাহিদের মেসে গিয়ে জাহিদকে বকাবকা শুরু করল। পরে জাহিদ তাকে অনেক অনুনয় করে ঠান্ডা করল। সাজেশন দিতে ভুলে গেছে তার জন্য জাহিদ ক্ষমা চেয়ে নিল। তারপর গল্পে গল্পে কেটে গেল অনেকক্ষণ। এবার উঠার পালা। কিন্তু হঠাত কান্না আর চেঁচামেচির আওয়াজ পেল তারা। সকাল সকলের উদ্দেশ্যে কি হয়েছে রে, কে কাঁদছে চলতো বাইরে গিয়ে দেখি।
সকালের সাথে সকলে “চল” বলে বাইরে বেরিয়ে আসল। চারিদিকে তাকিয়ে, কান পেতে শোনার চেষ্টা করল কান্নার শব্দ কোথা থেকে আসছে।
জাহিদ বলল- “কান্না হয়ত মেঘদের বাড়ির ঐদিক থেকে আসছে। চলতো গিয়ে দেখি। কার কি হল”।
যেই বলা সেই সকলে মিলে চলল কান্নার শব্দ অনুসরণ করে। গিয়ে থামল মেঘের বাসার সামনে। কান্নার শব্দটা মেঘের বাসা থেকেই আসছিল। তারা দেখে অনেক লোকের ভীড়। বাসার ভিতরে প্রবেশ করল তারা সবাই। সাবার আগে সকাল ভিতরে প্রবেশ করেই একজনকে জিজ্ঞাসা করল-“এখানে কি হয়ছে? এরা কান্না করছে কেন?” এসময় একজন বলল-“ আমাদের মেঘকে সাপে কেটেছে”।
মেঘের নাম বলার সাথে সাথে সকালের মাথাটা ঘুরে গেল, মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। মুর্তজা সকালের পিঠে হাত দিতেই সকালের চোখ ছলছল করে উঠল। সকাল আর থাকতে পারলোনা মানুষের ভীড় ঠেলে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। গিয়ে দেখে একটা চৌকির উপর যন্ত্রনায় ছটফট করছে মেঘ। চারিদিকে ঘিরে আছে ওদের বাসার মহিলারা। পাশে একজন মহিলা কাঁদছে হয়ত ওর মা। কারণ এর আগে সকাল কখনও ওর মা কে দেখেনি। সকালকে দেখে মেঘ হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। সকালও থাকতে পারলোনা। তার চৌকির পাশে তার মাথার কাছে গিয়ে বসলো। জাপটে ধরলো মেঘের হাত। কিছুই বলতে পারলোনা শুধু দুজনে দুজনার দিকে চেয়ে কাঁদতে লাগলো। জলের বন্যা বয়ে যেতে লাগলো দুজনার চোখে।
সকাল শুধু বলল-“ কি করে হলো এসব?”
খুব কষ্টে মেঘ বলল-“ ঘরে বসে পড়ছিলাম হঠাত পায়ে সাপে কামড় দিল” বলতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল তার। এই কষ্ট অনুভব করে সকাল মেঘকে চুপ করে থাকতে বললো। আর মুর্তজাকে ডাক্তার আনতে বললো। মুর্তজা বেরিয়ে গেল।
খুব কষ্ট করে মেঘ বলতে লাগলো-
“ জীবনের শেষ বেলায় তোমাকে দেখে যেতে পারলাম এবার তোমার কোলে মাথা রেখে মরলেও আমার সুখ”।
সকাল মেঘের মুখে হাত রেখে চুপ করে থাকতে বলল।
মেঘ তাকে বাধা দিয়ে বললো-“ সকাল আমার সময় শেষ। আমাকে শেষবারের মত মনের কথাগুলো বলতে দাও”।
“তুমি কি পাগল হয়ে গেলে? চুপ করো। তোমার কিছু হবেনা। আমি তোমাকে আমার জীবন থেকে হারিয়ে যেতে দেবনা”।
“সকাল, পাগলামো করো না। বড় আশা ছিল সারাজীবন তোমার পাশে থাকবো। সে আশা আর পূরণ হলো না। আমি তোমার হতে পারলাম না। একদিন বলেছিলাম আমি শুধু তোমারি। আর কেউ এই মনের অধিকারী না। কিন্তু আজ সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেল। আমি আমার কথা রাখতে পারলাম না। আমাকে ক্ষমা করো মনে রেখ না আর আমাকে”।
সকাল আর থাকতে পারলো না কান্নাজড়িত কন্ঠে বলে উঠল “মেঘ, তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পার না। আমি কাকে নিয়ে বাঁচব? তুমি ছাড়া আমি বড় একা”।
মেঘ সকালের হাত ধরে আছে। ক্রমশ তার কণ্ঠ নিস্তেজ হয়ে আসছে। কথা অস্পষ্ট হতে লাগলো। বিষে সমস্ত শরীর নীল হয়ে যাচ্ছে। যন্ত্রনায় কাতরাতে লাগলো। তারপরও সকালের হাত খানা শক্ত করে ধরে সে বললো-“ সকাল আমার মাথাটা তোমার বুকের মধ্যে শক্ত করে ধরো”। সকাল মেঘের কথা মত তার মাথাটা আলতো করে বুকের মাঝে চেপে ধরলো। মেঘের আর কথা বলার শক্তি নেই। আস্তে আস্তে সে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। মুখ দিয়ে ফেনার সাথে রক্ত বের হতে লাগলো। সকাল তার টি-শার্ট দিয়ে তা বারবার মুছে দিতে লাগলো। আর কোন কথা নয় শুধু দুজনা দুজনার দিকে চেয়ে চোখে অশ্রুর শ্রাবন ধারা বইতে লাগলো। মেঘ এক দৃষ্টিতে সকালের দিকে চেয়ে রইল। তারপর খুব কষ্টে একটু হাসলো। সেই হাসি মাখা মুখের দিকে সকাল তাকিয়ে রইল। মেঘের চোখের কোনা বেয়ে জলের ধারা বয়ে যেতে লাগল। নিস্তেজ হয়ে গেল মেঘ। চারিদিকে কান্নার রোল পড়ে গেল। সকাল বোবার মত মেঘের নিথর দেহটাকে বুকে জড়িয়ে বসে রইল।
বইটা যত্ন করে ব্যাগের মধ্যে রাখলো আর টি-শার্টে লেগে থাকা মেঘের রক্তমাখা ভালবাসার দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে তা ব্যাগের মধ্যে রেখে ব্যাগ গুছিয়ে নিল। তারপর ব্যাগ ঘাড়ে করে বাইরে বেরিয়ে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন খোঁজার চেষ্টা করতে লাগল। এবার এগিয়ে যাবার পালা তাই নিজের গন্তব্যে চলল সকাল। কত স্মৃতি, কত ভালবাসা, কত কষ্ট আর কত হাহাকার পিছন থেকে ডাক দিচ্ছে। সেদিকে না তাকিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলল সকাল পেছনে পড়ে রইল সব।
লেখকঃ জাহিরুল মিলন
সহকারি শিক্ষক (ইংরেজি)
শার্শা সরকারি পাইলট মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়, শার্শা, যশোর।
ডিপিআর/ জাহিরুল মিলন